IQNA

শেষ পর্ব;

ইমাম হুসাইন ( আ ) সাফীনাতুন্ নাজাত ও মিসবাহুল হুদা

23:16 - March 04, 2023
সংবাদ: 3473427
তেহরান (ইকনা): ৩য় শাবান মহানবীর (সা) দ্বিতীয় দৌহিত্র ( নাতি ) বেহেশত বাসী যুবকদের নেতা , মানবজাতির নাজাতের ( মুক্তি) তরী ( سفینة النجاة সফীনাতুন নাজাত ) , হিদায়তের প্রদীপ ( মিসবাহুল হিদায়াহ্ مصباح الهدایة ) হযরত মুহাম্মদের ( সা ) পবিত্র আহলুল বাইতের ( আ ) বারো মাসূম ইমামের তৃতীয় মাসূম ইমাম সাইয়িদুশ শুহাদা ( শহীদদের নেতা ) হযরত আবু আব্দিল্লাহ হুসাইন ইবনে আলীর ( আ ) শুভ জন্মদিন। শাবান মাসের এই আনন্দঘন শুভ দিনে সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও তাব্রীক ( অভিনন্দন ) ।

 ইমাম হুসাইন ( আ ) রাসূলুল্লাহর ( সা ) পবিত্র আহলুল বাইতের ( আ ) অন্তর্ভূক্তঃ
৮. আতা ইবনে ইয়াসার থেকে বর্ণিত । উম্ম-ই সালামাহ্ বলেনঃ ‘’ আমার ঘরেই নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ চান তোমাদের থেকে রিজস ( কলুষ , পাপপঙ্কিলতা ও নাপাকী ) দূর করতে হে আহলুল বাইত এবং তোমাদেরকে পবিত্র করার মতো ( সম্পূর্ণ রূপে ) পবিত্র করতে ।‘’ ---- এ আয়াতটি নাযিল হয়েছিল । উম্মে সালামাহ্ বলেনঃ ‘’ অতঃপর রাসূলুল্লাহ ( সা) আলী , ফাতিমা , হাসান ও হুসাইনের কাছে (পয়গাম) পাঠালেন ( অর্থাৎ  তাদেরকে ডেকে আনলেন) এবং এরপর বললেনঃ’’ এরাই আমার আহলুল বাইত ।‘’
هؤلاء أهل بیتي .
( হাকিম বলেনঃ) এটা বুখারীর শর্তে সহীহ হাদীস এবং তারা ( বুখারী ও মুসলিম তাদের গ্রন্থে ) তা ইখরাজ করেন নি ।  যাহাবী তার সাথে একমত পোষণ করে বলেছেনঃ (এ হাদীস) বুখারীর শর্তে ( সহীহ ) । ( দ্রঃ আল – মুস্তাদ্রাক , খঃ ৩ , পৃঃ ৩৫৭ , হাদীস নং ৪৭৬৩ )
 ৯. ওয়াসীলা ইবনে আস্কা’ বলেছেনঃ আমি হযরত আলীর কাছে আসলাম এবং তাঁকে পেলাম না ( অর্থাৎ তিনি ঘরে ছিলেন না ) । আর হযরত ফাতিমা আমাকে বললেনঃ তিনি ( আলী ) রাসূলুল্লাহর ( সা ) কাছে গেছেন তাকে ডেকে আনতে । অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহকে সাথে নিয়ে ফিরে আসলেন ; অতঃপর তারা দুজন ( রাসূলুল্লাহ ও আলী ঘরে ) প্রবেশ করলেন এবং আমিও তাদের সাথে প্রবেশ করলাম । এরপর রাসূলুল্লাহ ( সা ) হাসান ও হুসাইনকে ডাকলেন এবং তাদের দুজনকে তার দুই উরুর ওপর বসালেন এবং ফাতিমা ও তার স্বামীকে তার বক্ষদেশের কাছে এনে তাদের সবার ওপর একটি বস্ত্র ( চাদর ) টেনে দিলেন এবং তিলাওয়াৎ করলেনঃ নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ চান তোমাদের থেকে রিজস ( কলুষ , পাপপঙ্কিলতা ও নাপাকী ) দূর করতে হে আহলুল বাইত এবং তোমাদেরকে পবিত্র করার মতো ( সম্পূর্ণ রূপে ) পবিত্র করতে । ( আহযাব ৩৩ঃ ৩৩ ) অতঃপর তিনি ( সা) বললেনঃ এরাই আমার আহলুল বাইত । হে আল্লাহ ! আমার আহলুল বাইতই আহাক্ক ( সবচেয়ে সত্যপন্থী , হকদার ও সবচেয়ে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত ) ।
هؤلاء أهل بيتي اللهمّ أهل بيتي أحقّ
( হাকিম নিশাপুরী বলেনঃ ) এটা শাইখাইনের শর্তে সহীহ হাদীস এবং তারা তা ইখরাজ করেন নি । যাহাবী আত – তালখীস গ্রন্থে বলেছেনঃ ( এ হাদীস ) মুসলিমের শর্তে সহীহ । ( দ্রঃ প্রাগুক্ত , খঃ ৩ , পৃঃ ৩৫৭ , হাদীস নং ৪৭৬৪ )
 ১০. হযরত আয়েশা ( রাঃ ) বলেনঃ এক প্রত্যুষে রাসূলুল্লাহ ( সা ) বের হলেন এবং তাঁর ওপর ছিল কালো পশম নির্মিত নকশা অঙ্কিত একটি সেলাই বিহীন চাদর বা জামা । অতঃপর হাসান ও হুসাইন ( আ ) আসলে তিনি তাদের দুজনকে তার সাথে জামার ভিতরে ঢুকালেন , এরপর ফাতিমা আসলে তাকেও তিনি ( সা ) তাদের দুজনের সাথে ( জামার ভিতরে ) ঢুকালেন , এরপর আলী আসলে তাঁকেও তিনি ( সা ) তাঁদের সাথে জামার তলে ঢুকিয়ে তিলাওয়াত করলেনঃ নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ চান তোমাদের থেকে রিজস ( কলুষ , পাপপঙ্কিলতা ও নাপাকী ) দূর করতে হে আহলুল বাইত এবং তোমাদেরকে পবিত্র করার মতো ( সম্পূর্ণ রূপে ) পবিত্র করতে । ( সূরা – ই আহযাবঃ ৩৩ ) 
( হাকিম নিশাপূরী বলেনঃ ) এ হাদীসটি শাইখাইনের শর্তে সহীহ হাদীস এবং তারা তা ইখরাজ করেন নি । যাহাবী তার আত – তালখীস গ্রন্থে তার সাথে একমত পোষণ করে বলেছেনঃ ( এ হাদীস ) বুখারী ও মুসলিমের শর্তে ( সহীহ ) । ( দ্রঃ প্রাগুক্ত , খঃ ৩ , পৃঃ ৩৫৭ – ৩৫৮ , হাদীস নং ৪৭৬৫ )
সূরা – ই আহযাবের ৩৩ নং আয়াতের শানে নুযূল এবং বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে রাসূলুল্লাহ ( সা ) তাঁর নিজের পবিত্র আহলুল বাইতের ( আ) পরিচয় তুলে ধরেছেন   
যারা হচ্ছেন হযরত আলী , হযরত ফাতিমা , ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন ( আঃ ) ।
সূরা – ই আলে ইমরানের ৬১ নং আয়াতের শানে নুযূলে বর্ণিত হাদীস সমূহে ইমাম ভ্রাতৃদ্বয় ( হাসান ও হুসাইন – আ - ) রাসূলুল্লাহর দুই পুত্রসন্তান ( দৌহিত্র )

১১. আমর ইবনে সাদ স্বীয় পিতা ( সাদ ) থেকে । তিনি ( সাদ ) বললেনঃ অতঃপর তোমার কাছে জ্ঞান ( কুরআন ) এসে যাওয়ার পর যদি কেউ ( নজরানের খ্রিস্টানগণ ) তোমার সাথে তার ( ঈসার ) ব্যাপারে তর্ক বিতর্ক করে তবে বল ( আচ্ছা ময়দানে ) এস ,আমরা ডাকি আমাদের পুত্রসন্তানদেরকে এবং ( তোমরা ডাক ) তোমাদের পুত্র সন্তানদেরকে , ( আমরা ডাকি ) আমাদের নারীদেরকে এবং ( তোমরা ডাক ) তোমাদের নারীদেরকে , ( আমরা ডাকি ) আমাদের নিজ সত্তাদেরকে এবং ( তোমরা ডাক ) তোমাদের নিজ সত্তাদেরকে , অতঃপর সকলে মিলে (আল্লাহর দরবারে ) নিবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর লানত ( অভিসম্পাত ) বর্ষণ করি ।   ( সূরা – ই আলে ইমরানঃ ৬১ ) । --- এ আয়াতটি নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) আলী , ফাতিমা , হাসান ও হুসাইনকে  ( রাঃ ) ডেকে বললেনঃ এরাই আমার আহল ( আহলুল বাইত ) ।
 
( হাকিম নিশাপুরী বলেনঃ )  শাইখাইনের ( বুখারী ও মুসলিম ) শর্তে এ টি সহীহ হাদীস এবং তারা তা ইখরাজ করেন নি । আর যাহাবী আত - তালখীস গ্রন্থে তার সাথে একমত পোষণ করে বলেছেনঃ ( হাদীসটি ) বুখারী ও মুসলিমের শর্তে ( সহীহ ) । ( প্রাগুক্ত , পৃঃ ৩৬০ – ৩৬১ হাদীস নং ৪৭৭৭ ) 
১২.স্বীয় পিতা সাদ থেকে জাবির ইবনে সাদঃ সাদ বলেনঃ  আমরা ডাকি আমাদের পুত্র সন্তানদেরকে ( তোমরা ডাক ) তোমাদের পুত্র সন্তানদেরকে ..... এ আয়াত যখন নাযিল হয় তখন রাসূলুল্লাহ ( সা) আলী , ফাতিমা , হাসান ও হুসাইনকে ডেকে বললেনঃ হে আল্লাহ ! এরাই আমার আললুল বাইত । এ হাদীসের ইসনাদের বিশুদ্ধতার ওপর শাইখাইন ( বুখারী ও মুসলিম ) একমত পোষণ করেছেন এবং এ ইসনাদের ভিত্তিতে ইহতিজাজ ( প্রমাণ ও যুক্তি পেশ ) করেছেন । তবে এ ইসনাদের ভিত্তিতে এ হাদীসটি ইখরাজ করেন নি । কিন্তু তারা এ ইসনাদের ভিত্তিতে আবূ তুরাবের কাহিনী বর্ণনা ( ইখরাজ ) করেছেন ( নিজ নিজ হাদীস গ্রন্থে ) ।  ( দ্রঃ প্রাগুক্ত , হাদীস নং ৪৭৭৯ , পৃঃ ৩৬১ )
এ আয়াত ( সূরা – ই আলে ইমরানঃ ৬১ ) মুবাহালার আয়াত নামে প্রসিদ্ধ । এ আয়াতের  শানে নুযুলের হাদীস সমূহ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে মহানবীর ( সাঃ ) পবিত্র মাসূম আহলুল বাইত ( আঃ ) তাঁর জীবদ্দশায় কেবল হযরত আলী , হযরত ফাতিমা , ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন ( আ ) যাঁদেরকে তিনি ( সা) মুবাহালার দিবসে নাজরানের খ্রীষ্টানদের সাথে তাঁর নুবুওয়াত ও ইসলামের সত্যতা প্রমাণের মুবাহালায় নিজের সাথে এনেছিলেন । যেহেতু আহলুল বাইত ( আঃ ) মাসূম ছিলেন সেহেতু কেবল তাঁরাই হয়েছিলেন রাসূলুল্লাহর নুবুওয়াত ও ইসলামের সত্যতার সাক্ষী এবং মুবাহালায় তাঁর ( সাঃ ) সঙ্গী । আর এই কারণে তাঁরা ব্যতীত উম্মতের অন্য কোনো ব্যক্তিকে সাথে নেন নি রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) । কারণ , রাসূলুল্লাহর ( সাঃ ) জীবদ্দশায় কেবল তাঁর আহলুল বাইত ( আলী , ফাতিমা , হাসান ও হুসাইন – আঃ – যারা ছিলেন আসহাব-ই কিসা তাঁরা ) ব্যতীত উম্মতের আর কোনো ব্যক্তি মাসূম ছিলেন না । 
হযরত ইমাম হাসান ( আ ) ও ইমাম হুসাইন ( আ ) ছিলেন সবচেয়ে সত্য়বাদিনী নারীর ( হযরত ফাতিমার – আ - ) সন্তান । আর ফাতিমা ছিলেন মহানবীর ( সাঃ ) পরে সবচেয়ে সত্যবাদিনী ( পরম সত্যবাদিনী ) অর্থাৎ সিদ্দীকা বরং সিদ্দীকা হযরত মারয়াম বিনতে ইমরানের ( আ ) চেয়েও অধিক পরম সত্যবাদিনী ( অধিক সিদ্দীকা ) এবং এ কারণে তিনি ( নবীদুহিতা হযরত ফাতিমা ) হচ্ছেন সিদ্দীকা -ই কুবরা এবং বেহেশতের নারীদের নেত্রী এমনকি হযরত মারয়ামের ( আ )ও নেত্রী । কারণ , মহানবী ( সা ) সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল । মহানবী ( সা ) কর্তৃক আনয়নকৃত ইসলাম , ঐশী  জ্ঞান , মারেফাত ,  আখলাক ,  শরিয়ত ,  পবিত্র আসমানী গ্রন্থ কুরআন এবং তাঁর সুন্নাহ হচ্ছে  সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ এবং সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ধর্ম , জ্ঞান - মারেফাত , আখলাক ( চারিত্রিক গুণ ও বৈশিষ্ট ) , শরিয়ত , আসমানী গ্রন্থ ও সুন্নাহ্  । আর সমগ্র সৃষ্টিকুলের মধ্যে মহানবীর ( সা ) পরে তাঁর পবিত্র আহলুল বাইতই ( আ ) সর্বশ্রেষ্ঠ । কারণ এই উম্মত সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত এবং আহলুল বাইত ( আ ) হচ্ছেন এই উম্মতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং উম্মতের নেতা ( মাওলা ও ওয়ালী )  এবং  তাঁরা ( আহলুল বাইত ) রাসূলুল্লাহর ( সা ) অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তাঁরা ( আহলুল বাইত ) এই সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বীন ( ধর্ম ) , জ্ঞান – মারেফাত , আখলাক  , শরিয়েত , আসমানী ঐশী গ্রন্থ ( পবিত্র কুরআন ) ও মহানবীর ( সা ) সুন্নাহর ধারক ও বাহক যা মুতাওয়াতির হাদীস -ই সাকালাইন  থেকে প্রমাণিত । সুতরাং আহলুল বাইত এ কারণেই পূর্ববর্তী সকল নবী – রাসূল , উম্মতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং পূর্ববর্তী কোনো নবী – রাসূলের সময় দ্বীন ( ধর্ম ) ,ঐশী ইলাহী জ্ঞান – মারেফাত , আখলাক , শরিয়ত , আসমানী ঐশী কিতাব ও সুন্নাহ্ পূর্ণতা লাভ করে নি। তাই নিঃসন্দেহে হযরত ফাতিমা ( আ ) মারয়াম ও আসিয়া সহ সকল নারীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ , সিদ্দীকা -ই কুবরা এবং সকল নারীর নেত্রী । এমন মায়ের সন্তান হচ্ছেন ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন এবং নিঃসন্দেহ এটা তাঁদের অতুলনীয় মর্য্যাদা ও শান ।      
১৩.হযরত আয়েশা ( রাঃ ) থেকে । যখনই তাঁর কাছে হযরত ফাতিমা বিনতুন নবীকে স্মরণ করা হত তখনই তিনি বলতেনঃ আমি ফাতিমার চেয়ে অধিক সত্যবাদী আর কোনো ব্যক্তিকে দেখি নাই একমাত্র তাঁকে যিনি জন্ম দিয়েছেন কেবল তিনি ( রাসূলুল্লাহ – সা - ) ব্যতীত । 
ما رأیت أحدا کان أصدق لهجة منها إلّا الّذي ولدها 
( হাকিম নিশাপুরী বলেনঃ ) এটি মুসলিমের শর্তে সহীহ হাদীস এবং তারা ( বুখারী ও মুসলিম ) তা ইখরাজ করেন নি । আর যাহাবী আত – তালখীস গ্রন্থে তার  সাথে একমত পোষণ করে বলেছেনঃ মুসলিমের শর্তে ( এ হাদীসটি সহীহ ) । ( দ্রঃ প্রাগুক্ত , পৃঃ ৩৭১ , হাদীস নং ৪৮১৭ ) 
পবিত্র কুরআন ও মহানবীর ( সাঃ ) আহলুল বাইত ( আ ) মহানবীর (সা) রেখে যাওয়া দুটো ভারী আমানত এবং এ দুভয় কখনোই পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না । 
১৪ . হযরত যাইদ ইবনে আরকাম ( রা ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ ( সা ) বলেছেনঃ নিশ্চয় আমি তোমাদের মাঝে রেখে যাচ্ছি দুটো অতি ভারী জিনিস ( সাকালাইন )ঃ মহান আল্লাহর গ্রন্থ ( পবিত্র কুরআন ) এবং আমার আহলুল বাইত এবং এ দুটো আমার কাছে হাউযে উপনীত হওয়া পর্যন্ত কখনোই পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না । 
( হাকিম নিশাপুরী বলেনঃ ) এটা শাইখাইনের শর্তে সহীহুল ইসনাদ হাদীস এবং তারা ( বুখারী ও মুসলিম ) তা ইখরাজ ( তাদের গ্রন্থে পূর্ণ সনদ সহ রিওয়ায়ত ) করেন নি । আর যাহাবী আত – তালখীস গ্রন্থে তার সাথে একমত পোষণ করে বলেছেনঃ বুখারী ও মুসলিমের শর্তে ( এ হাদীস সহীহ ) । ( দ্রঃ প্রাগুক্ত , হাদীস নং ৪৭৬৯ , পৃঃ ৩৫৯ )  
    সাকালাইনের হাদীস মুতাওয়াতির । এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে মহানবীর ( সা )  আহলুল বাইত ( আ ) যাদের পরিচিতি আয়াত-ই তাতহীর ( সূরা-ই আহযাবের ৩৩ নং আয়াত ) এবং মুবাহালার আয়াতের ( সূরা-ই আলে ইমরানঃ ৬১ ) শানে নুযুলে মহানবী ( সা ) থেকে বর্ণিত সহীহ প্রতিষ্ঠিত মুতাওয়াতির হাদীস সমূহে তুলে ধরা হয়েছে তাঁরা সবাই পবিত্র কুরআনের সাথে এবং পবিত্র কুরআনও তাঁদের সাথে চিরকাল বিদ্যমান থাকবে এবং তারা (আহলুল বাইত ) এ গ্রন্থের প্রকৃত ব্যাখ্যাকারী ( মুফাস্সির , ইসলাম ও সুন্নাহর ধারক বাহক এবং উম্মাহর মারজা ( অর্থাৎ দ্বীনী জ্ঞান ও মারেফাত , শরিয়তের বিধিবিধান এবং আখলাক (নীতি নৈতিকতা শিষ্ঠাচার) সবকিছুর জন্য় উম্মতকে তাদের কাছে রুজু করতেই হবে অন্যের কাছে নয় এবং তাদেরকে আকড়ে ধরার অর্থ হচ্ছে পবিত্র কুরআনকেই আকড়ে ধরা । সুতরাং আহলুল বাইত উম্মাহর আদর্শ ( উসওয়াহ ) এবং হাদী ( পথপ্রদর্শক ) । পবিত্র কুরআন যেমন মাসূম ( পবিত্র ও বিশুদ্ধ ) ঠিক তেমনি আহলুল বাইতও সকল পাপ , ভুল – ভ্রান্তি এবং বিস্মৃতি থেকে মাসূম ( পবিত্র , বিশুদ্ধ ও নিষ্পাপ )। তা না হলে পবিত্র কুরআন ও আহলুল বাইতের এ সহবিদ্যমানতা ( তালাযুম ) , অবিচ্ছিন্নতা ও অবিচ্ছেদ্যতার কোনো মানেই হয় না । স্মর্তব্য যে আহলুল বাইতের অপরাপর সদস্যের মতোই ইমাম হুসাইন (আ)ও পবিত্র কুরআনের সাথে আছেন এবং কখনোই এ গ্রন্থে থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন না । আর এ কারণেই আহলুল বাইত ( আ ) মুসলিম উম্মাহর একমাত্র বৈধ কর্তৃপক্ষ । এতদর্থে আহলুল বাইত ( আ ) কি শুধু এই পাঁচ জনের মাঝেই সীমাবদ্ধ নাকি আহলুল বাইতের ( আ ) আরো সদস্য আছেন ? সাকালাইনের হাদীসে কিয়ামত পর্যন্ত সকল যুগে পবিত্র কুরআন ও আহলুল বাইতের মধ্যকার সহবিদ্যমানতা এবং অবিচ্ছেদ্যতা ও অবিচ্ছিন্নতা থেকে প্রমাণিত হয় যে প্রতিটি যুগে এই ইহলোকে পবিত্র কুরআনের সাথে পবিত্র মাসূম আহলুল বাইতের অন্ততঃ এক জন সদস্য বিদ্যমান থাকবেনই যিনি অবশ্যই হবেন যুগের ইমাম ও মহান আল্লাহর হুজ্জাত । প্রতিটি যুগেই মাসূম হুজ্জাত ইমাম বিদ্যমান থাকতেই হবে যাকে না চিনলে এবং আনুগত্য না করলে মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু । আর সহীহ প্রতিষ্ঠিত প্রমাণিত হাদীসে এ উম্মাতের বারো ইমাম , খলীফা , আমীরের কথা বলা হয়েছে যারা মহানবীর পরে কিয়ামত পর্যন্ত একের পর এক আগমন করবেন । তাহলে সমগ্র উম্মতের কাছে সহীহ প্রতিষ্ঠিত নির্ভরযোগ্য মুতাওয়াতির অকাট্য হাদীস সমূহের আলোকে পবিত্র কুরআনের সমকক্ষ ( ইদল عدل) মাসূম আহলুল বাইতের অন্তর্ভুক্ত এ বারো ইমাম যারা মহানবীর পরে কিয়ামত পর্যন্ত হবেন যুগের ইমাম । প্রতিটি যুগেই তাঁরা বিদ্যমান থাকবেন এবং সৃষ্টি জগতের ওপর তাঁরা হচ্ছেন মহান স্রষ্টার হুজ্জাত ( দলীল ) এবং মহানবীর ( সা ) সময় আহলুল বাইতের ( আ ) তিনজন মাসূম ইমামঃ ইমাম আলী (আ) , ইমাম হাসান ( আ ) এবং ইমাম হুসাইন ( আ ) বিদ্যমান ছিলেন এবং ইমাম হুসাইনের শাহাদতের পরে তাঁর বংশধারায় আরো ৯ মাসূম ইমাম একের পর এক এসেছেন এবং সর্বশেষ অর্থাৎ দ্বাদশ ইমাম যিনি হচ্ছেন একাদশ মাসূম ইমাম হাসান আল্ – আস্কারীর ( আ ) পুত্র ইমাম মাহদী ( আ ) তিনি দীর্ঘকালীন গাইবতে ( অন্তর্ধান ) আছেন এবং মহান যখন ইচ্ছা করবেন তখন তিনি গাইবত থেকে আবির্ভূত হয়ে সমগ্র বিশ্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করবেন এবং তখন ইসলাম এবং মুসলিম উম্মাহ্ সকল ধর্ম ও জাতিসমূহের ওপর জয়যুক্ত হবে । এতদ সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন যা এই ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভব নয় ।         
১৫. হযরত আবূ হুরাইরা ( রাঃ ) বলেনঃ মহানবী ( সাঃ ) আলী , ফাতিমা , হাসান এবং হুসাইনের ( আ ) দিকে তাকিয়ে বললেনঃ আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত যে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং তার সাথে শান্তি ও সন্ধিরত যে তোমাদের সাথে সন্ধি করে এবং শান্তি স্থাপন করে । 
( হাকিম নিশাপুরী বলেনঃ ) এটা হাসান হাদীস তালীদ ইবনে সুলাইমান থেকে আবূ আব্দিল্লাহ আহমাদ ইবনে হান্বালের হাদীসের কারণে । কারণ আমি এ রিওয়ায়ত ছাড়া তার আর কোনো রিওয়ায়ত পাই নি । 
যাহাবী তার আত – তালখীস গ্রন্থে এ হাদীস সনদ ও মতন সহ এনেছেন কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে মন্তব্য করা থেকে চুপ থেকেছেন । ( দ্রঃ প্রাগুক্ত , হাদীস নং ৪৭৭১ , পৃঃ ৩৫৯ )  
১৬. যাইদ ইবনে আরকাম বলেনঃ মহানবী ( সা ) আলী , ফাতিমা , হাসান ও হুসাইনকে বললেনঃ আমি যুদ্ধরত তার বিরুদ্ধে যার বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ কর এবং আমি তার সাথে সন্ধি ও শান্তি স্থাপন করি যার সাথে তোমরা সন্ধি ও শান্তি স্থাপন কর । ( দ্রঃ প্রাগুক্ত , পৃঃ ৩৫৯ , হাদীস নং ৪৭৭২ ) 
উপরিউক্ত হাদীস সমূহের আলোকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে ইমাম হুসাইনই (আ) হচ্ছেন নাজাতের তরী এবং হিদায়তের প্রদীপ এবং এই মহাসত্য কারবালায় স্পষ্ট প্রতিভাত হয়েছিল । আর এতদসংক্রান্ত হাদীসও বিদ্যমান আছে । যেমনঃ
১৭.একদা মহানবী ( সা ) সাহাবী উবাই ইবনে কাবের ( রা ) সাথে আলাপ কালে ইমাম হুসাইনের ( আ ) সিফাত ( গুণ ) ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বললেনঃ মহান আল্লাহর আরশের ডান পাশে লিখিত আছেঃ (হুসাইন) পথপ্রদর্শনকারী প্রদীপ এবং নাজাতের তরী  ((দ্রঃ শেখ সাদূক সংকলিত কামালুদ্দীন এবং উয়ূনু আখবারির রিযা ( আ ) ))
مکتوب عن يمين عرش الله عزّ و جلّ : مصباح هاد و سفينة نجاة .
আল্লামাহ তাবার্সী সংকলিত গ্রন্থ ইলামুল ওয়ারায় এ হাদীসটি এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ মহান আল্লাহর আরশের ডান পাশে অবশ্যই লিখিত আছঃ ( হুসাইন) পথপ্রদর্শনকারী প্রদীপ এবং নাজাতের তরী ।
আস-সিরাতুল মুস্তাকীম গ্রন্থে এ হাদীসটি এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ আরশের ডানপাশে লিখিত আছেঃ আর নিশ্চয়ই তিনি ( হুসাইন) হিদায়তের প্রদীপ এবং নাজাতের ( মুক্তি ) তরী । 
ইমাম হুসাইন ( আ ) কারবালায় স্বীয় জীবন এবং সঙ্গী – সাথী , সন্তান – সন্ততি , পরিবার – পরিজন ও আত্মীয় – স্বজনদেরকে মহান আল্লাহর পথে এবং মহান আল্লাহর ধর্ম ইসলামকে রক্ষার জন্য কুরবানী করেছিলেন এবং তাঁর আহলুল বাইতের ( আ ) নারী ও শিশুরা বন্দী হয়েছিলেন পাপীষ্ঠ নরাধম ইয়াযীদীদের হাতে । এ ভাবে খোদার দ্বীনকে রক্ষা করার নযীর মানব জাতির ইতিহাসে বিদ্যমান নেই । ইমাম হুসাইন নিজের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ইসলাম , পবিত্র কুরআন , রাসূলুল্লাহর পবিত্র সুন্নাহ এবং পথহারা উম্মতকে কারবালায় তাঁর নিজের শাহাদত বরণের মাধ্যমে রক্ষা করেছিলেন বলেই মহানবী ( সা ) যথার্থই বলেছেনঃ হুসাইন হিদায়তের প্রদীপ ও নাজাতের তরী । তাই ইমাম হুসাইন ( আ ) এবং মহানবীর ( সা ) আহলুল বাইতের  ( আ ) পথ ও আদর্শই হচ্ছে পবিত্র কুরআনের পথ , সাকালাইনের পথ অর্থাৎ সিরাত – ই মুস্তাকীম ( সরল সোজা সঠিক পথ ) । আর এ পথে চললেই কেবল মুক্তি ও নাজত পাওয়া সম্ভব । অন্য কোনো পথে নয় । কারণ অন্য সকল পথে বক্রতা , বিচ্যুতি ও ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই নেই । তাই মুসলমানদের উচিৎ ইমাম হাসানকে , ইমাম হুসাইনকে এবং তাঁদের মাতামহ রাসূলুল্লাহ ( সা ) এবং তাঁদের পিতামাতাকে ভালোবাসা এবং তাঁদের পথ ও আদর্শ অনুসরণ করা । হযরত আলী ইবনে আবী তালিব ( আ ) বর্ণনা করেছেনঃ  মহানবী ( সাঃ )  হাসান ও হুসাইনের হাত ধরে বললেনঃ যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে , এই দুজনকে , এদুজনের পিতাকে এবং এদুজনের মাতাকে ভালোবাসে সে কিয়ামত দিবসে আমার সাথে আমার স্থানে  আছে (থাকবে ) । 
عن علي بن أبي طالب أنّ رسول الله – ص – أخذ بيد حسن و حسين فقال : مَن أحبَّني و أحبّ هذين و أباهما و أمّهما کان معي في درجتي يومَ القیامة .
আবূ ঈসা তির্মিযী বলেছেনঃ এটা হাসান গরীব হাদীস । কেবল এ  সনদের  মাধ্যমেই আমরা হযরত জাফার ইবনে মুহাম্মাদ ( আ ) থেকে এ হাদীসটি জেনেছি এবং এর সাথে পরিচিত আছি । ( দ্রঃ সুনানুত তিরমিযী , কিতাবুল মানাক্বিব , হাদীস নং ৩৭৪২ , পৃঃ ৯৮২ , ১ম সংস্করণ , দার ইহয়ায়িত তুরাস আল-আরাবী , বৈরুত , লেবানন ) ।
সাফীনাতুন্নাজাত ও মিসবাহুল হুদা ইমাম হুসাইনের ( আ ) শুভ জন্মদিবসে আমরা ইমাম হুসাইনকে (আ) স্মরণ করব এবং মহান আল্লাহর কাছে একান্ত বিনীত প্রার্থনা যে তিনি আমাদেরকে ইমাম হুসাইনের (আ) ফাযায়ল থেকে শিক্ষা নিয়ে তাঁর নাজাতের তরীতে আরোহন করে  তাঁর হিদায়তের প্রদীপের আলোয় সিরাত-ই মুস্তাকীমে পথ চলার তৌফিক দেন ।  
ইসলামী চিন্তাবিদ এবং গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান।
 
সমাপ্ত

 

captcha