IQNA

ইসলামী গবেষক:

ঈদে গাদীর উদযাপন

15:13 - July 11, 2023
সংবাদ: 3474026
তেহরান (ইকনা): যিল হজ্জ মাস আশহুরুল হজ্জ ( ِّأَشْهُرُ الحَج ) অর্থাৎ হজ্জের মাস  সমূহের ( শাওওয়াল , যিল ক্বদ ও যিল হজ্জ ) শেষ মাস এবং আশহুরুল হুরুমের ( নিষিদ্ধ মাস সমূহ : যিল ক্বদ্ , যিল্ হজ্জ্ , মুহররম ও রজব এবং এ চার মাসে যুদ্ধ হারাম অর্থাৎ অবৈধ ও নিষিদ্ধ ) ২য় মাস । আর এ মাস মহানবীর ( সা ) আহলুল বাইতের ( আ ) - এর মাস । কারণ এ মাসে ইসলামের ইতিহাসের প্রথম , ২য় ও ৩য় শতাব্দীর বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে যেগুলো মহানবীর (সা) আহলুল বাইতের ( আ ) সাথে জড়িত ও সংশ্লিষ্ট ।

এ মাস আহলুল বাইতের (আ) ওয়িলায়ত এবং ইসলাম ধর্মের পূর্ণতার মাসও ( شهر ولایة اهل بیت رسول الله ) কারণ ১৮ যিল হজ্জ মহানবী (সা) মহান আল্লাহর নির্দেশে তাঁর ( সা ) পরে হযরত আলীকে ( আ ) মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যত নেতা , কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক , শাসনকর্তা ও খলীফা ( স্থলাভিষিক্ত) ঘোষণা করেন পবিত্র মক্কা থেকে হজ্জ ব্রত পালন শেষে পবিত্র মদীনায় ফেরার পথে জুহফার কাছে খুমের জলাশয় ( গাদীর - ই খুম ) নামক স্থানে আয়োজিত বিশাল জন সমাবেশে এবং বলেন :" আমি যার মাওলা এই আলী তার মাওলা ( من کنت مولاه فهذا علي مولاه ) । "
বার্রা ইবনে আযিব ( রা ) থেকে বর্ণিত : আমরা রাসূলুল্লাহর ( সা ) সাথে তার সমাপনী হজ্জে  ছিলাম। অত:পর তিনি পথিমধ্যে যাত্রা বিরতি করেন এবং জামাতে নামাজ আদায়ের আদেশ দেন । অত:পর তিনি হযরত আলীর ( আ ) হাত ধরে বললেন : " আমি কি মুমিনদের চেয়ে তাদের নিজেদের কাছে অধিকতর নিকটবর্তী ( অধিকতর অগ্রাধিকার ও প্রাধান্য প্রাপ্ত এবং অধিকতর হকদার : আওলা)  নই ? " তখন সবাই বলল :" হ্যাঁ। " তিনি ( সা ) বললেন : " আমি কি প্রত্যেক মুমিনের নিজের চেয়ে তার কাছে অধিকতর নিকটবর্তী ( অধিকতর অগ্রাধিকার ও প্রাধান্য প্রাপ্ত এবং অধিকতর হকদার: আওলা أَوْلیٰ ) নই ? " তারা সবাই বলল : " হ্যাঁ। " তিনি ( সা ) বললেন : " অতএব এ ( আলী ) ঐ ব্যক্তির মাওলা যার মাওলা হচ্ছি আমি । হে আল্লাহ !  যে তাঁকে ভালোবাসে ও সাহায্য করে তাকে আপনি ভালোবাসুন ও সাহায্য করুন এবং যে তাঁর সাথে শত্রুতা করবে তাঁর সাথে শত্রুতা করুন । " ( দ্র : ইবনে মাজাহ , আলবানী সাহীহ ইবনে মাজাহ্ এ রেওয়াতটা সাহীহ বলেছেন, খ : ১ , পৃ : ২৬ , হাদীস নং ১১৩ )
 
সুতরাং মাওলা শব্দের অর্থ যে অধিকতর নিকটবর্তী ( আপন ) অধিকতর অগ্রাধিকার ও প্রাধান্য প্রাপ্ত এবং হকদার তা এ সহীহ হাদীসের শুরুতে মহানবীর ( সা ) উক্তি : " আমি কি মুমিনদের চেয়ে তাদের নিজেদের কাছে অধিকতর নিকটবর্তী ( অধিকতর অগ্রাধিকার ও প্রাধান্য প্রাপ্ত এবং অধিকতর হকদার  অর্থাৎ আওলা ) নই ? " - থেকে খুব ভালো ভাবে ও স্পষ্ট বোধগম্য । আর মুমিনদের কাছে মুমিনদের চেয়ে  অধিকতর নিকটবর্তী ও আপন হওয়ার কারণেই মহানবী ( সা ) মুমিনদের অর্থাৎ মুসলিম উম্মাহর সকল বিষয়ের তত্ত্বাবধানকারী কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক ও শাসনকর্তা )
আর অধিকতর নিকটবর্তী অধিকতর অগ্রাধিকার ও প্রাধান্য প্রাপ্ত এবং অধিকতর হকদার হওয়ার অনিবার্য পরিণতি ও অর্থ হচ্ছে যে মহানবী (সা) মুমিনদের অর্থাৎ মুসলিম উম্মাহর ওয়ালী ( অভিভাবক , উম্মাহর সকল বিষয়ের তত্ত্বাবধানকারী কর্তৃপক্ষ ও শাসনকর্তা অর্থাৎ মুতাসার্রিফ ফী উমূরিল উম্মাহ متصرِّف في أمور الأمّة ) । আর এ কারণেই হযরত আলী ( আ )ও মুসলিম উম্মাহর ওয়ালী [ ইমাম ( নেতা ) , অভিভাবক, তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃপক্ষ ও শাসনকর্তা ]। আর এ কারণেই তিনি ( আ ) মহানবীর (সা) পরে তাঁর খলীফা ও স্থলাভিষিক্ত । কারণ তিনিই অন্য সকলের চেয়ে মহানবীর (সা) খলীফা ও স্থলাভিষিক্ত ( জানশীন) হওয়ার উপযুক্ত ও হকদার যা উক্ত সহীহ হাদীস থেকে স্পষ্ট প্রতিপন্ন ও প্রতীয়মান হয়। আর মহানবী ( সা ) ১০ হিজরীর ১৮ যিল হজ্জ গাদীর -ই খুমের মহা সমাবেশে তাঁর পরে মুসলিম উম্মাহর মাওলা ( ধর্মীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতা , অভিভাবক এবং হিদায়ত ও সার্বিক তত্ত্বাবধানের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ) হিসেবে মহা ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন এবং এর ফলে দ্বীনে ইসলামের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত হয় যদ্দরুণ কাফির মুশরিক ও মুনাফিক গণ সম্পূর্ণ হতাশ ও নিরাশ হয়ে পড়ে । কারণ তারা ভেবে ছিল যে মহানবীর (সা) মৃত্যু হলে এ ধর্ম টিকিয়ে রাখার কোন উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ এবং অভিভাবক ও তত্ত্বাবধায়ক নেতা থাকবে না এবং তখন তারা যে বহু যুদ্ধ বিগ্রহ ও শত্রুতা করেও মহানবীর (সা) কাছে আদর্শিক , ধর্মীয় ,  রাজনৈতিক ও সামরিক ভাবে পরাজিত হয়েছিল এবং নাম কে ওয়াস্তে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল অনায়াসে  ইসলাম , মহানবী , তাঁর আহলুল বাইত ( আ ) বিশেষ করে হযরত আলী ( আ ) ও মুসলমানদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ এবং জাহিলী যুগের ধর্মের দিকে ফিরে যাওয়ার মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যাবে । কিন্তু মহানবীর ( সা ) এ ঘোষণা তাদের সম্পূর্ণ নিরাশ করে দেয় । আর এ কারণেই মহান আল্লাহ দ্বীনের ভবিষ্যতের ব্যাপারে কাফির দের হতাশ ও নিরাশ হওয়া , ইসলাম ও নেয়ামতের পূর্ণতা এবং একমাত্র ধর্ম হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করার ঘোষণা দানের আয়াত অবতীর্ণ করেন : 
 
الیوم یئس الذین کفروا من دینکم فلا تخشوهم واخشون . الیوم أکملت لکم دینکم و أتممت علیکم نعمتي و رضیت لکم الإسلام دیناً .
 
আজ তোমাদের ধর্ম সম্পর্কে কাফিররা হতাশ ও নিরাশ হয়ে গেছে। অতএব তাদেরকে তোমরা ভয় করো না এবং আমাকে তোমরা ভয় করো । আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণ করে দিলাম , তোমাদের ওপর আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য কেবল ইসলামকেই আমি মনোনীত করলাম । ( সূরা -ই মায়েদা ৫ : ৩ ) আর এ আয়াত অবতীর্ণ 
হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ ( সা ) বললেন : " আল্লাহু আকবার ( আল্লাহ সবচেয়ে মহান ) আলী দ্বীনের চূড়ান্ত পূর্ণতা এবং নেয়ামতের সম্পূর্ণত্ব এবং আমার রিসালতের ব্যাপারে প্রভুর সন্তুষ্টি। আর আমার পরেই হচ্ছে আলীর ওয়িলায়ত ।"
এরপর সবাই হযরত আলীকে ( আ) মুমিনদের আমীর ( নেতা ) হওয়ার জন্য অভিনন্দন জ্ঞাপন করতে লাগল । হযরত আবুবকর ( রা ) ও /হযরত উমর ( রা ) হযরত আলীকে ( আ ) বলছিলেন : সাবাস ! সাবাস ! আপনাকে হে ইবনে আবী তালিব ! আপনি আমার ও প্রত্যেক মুমিন নর নারীর মাওলা হয়েছেন ।
 
আর হযরত আলী ( আ ) ও আহলুল বাইতের ( আ ) ওয়িলায়ত ও ইমামতের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দানের মাধ্যমে ইসলামের পূর্ণতা বিধান হয় বলে গাদীর -ই খুম দিবস ( ১৮ যিল হজ্জ ) মহানবী ( সা ) ও তাঁর আহলুল বাইতের ( আ ) কাছে মহান আল্লাহর মনোনীত সবচেয়ে বড় ঈদ ( ঈদুল্লাহিল আকবর ) । আর মুতাওয়াতির হাদীস - ই সাকালাইন অনুযায়ী আহলুল বাইত ( আ ) এবং পবিত্র কুরআন কোনো দিন পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না । অতএব মহান আহলুল বাইতের (আ) কাছে যে ঈদ সবচেয়ে বড় ঈদ সেটাই প্রকৃত সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে বড় ঈদ মুসলিম উম্মাহর জন্য ।
এ মহা ঘোষণা দান এবং দ্বীন ও নেয়ামতের পূর্ণতার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর মহানবী ( সা ) উপস্থিত জনতাকে হযরত আলীর (আ) ওয়িলায়তের বাই'আত করতে ও তাঁকে মুমিন নরনারীর মাওলা হওয়ার অভিনন্দন জানাতে আদেশ দেন যা সুষ্ঠু ভাবে পালিত হয় এবং এটাই হচ্ছে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা) ও জনতা কর্তৃক গাদীর -ই খুম দিবস ( ১৮ যিল হজ্জ) দ্বীন ও নেয়ামতের পূর্ণতার ঈদ ( উৎসব ) হিসেবে সর্বপ্রথম পালিত ও উদযাপিত হয় । অতএব মহানবী ( সা ) এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা) ছিলেন গাদীর -ই খুম দিবসের প্রথম উদযাপনকারী । কিন্তু মহানবীর (সা) পরে পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেলে ঈদ - ই গাদীর উদযাপন মুসলিম উম্মাহর মাঝে তখন সম্ভব হয় নি । কারণ প্রথম তিন খলীফার আমলে হাদীস সংকলন ও বর্ণনা নিষিদ্ধ করা হয় এবং তা প্রায় ৯০ বছর স্থায়ী ছিল । তাই ঐ সময় হাদীস - ই গাদীর সহ  হাদীস বর্ণনা নিষিদ্ধ থাকায় ঈদ - ই গাদীর উদযাপন সম্ভব ছিল না। হযরত আলী ( আ ) শাসনামলে কূফার রাহবা সহ বিভিন্ন উপলক্ষে হাদীস - ই গাদীরের মাধ্যমে জনগণ ও তাঁর প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ ( ইহতিজাজ ও ইনশাদ ) করেছেন যাতে জনগণ যেন হাদীস - ই গাদীরের সাথে পরিচিত হয় । কারণ দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে হাদীস বর্ণনা 
বিশেষ করে হাদীস - ই গাদীর বর্ণনা নিষিদ্ধ ছিল । আর হাদীস বর্ণনা ও চর্চা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল যাতে জনগণ এ ধরনের হাদীসের সাথে বিন্দুমাত্র পরিচিত হতে না পারে । আর হযরত আলীর (আ) শাহাদাতের পর আহলুল বাইত ( আ ) ও হযরত আলী বিদ্বেষী ও বৈরী উমাইয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়ে ৯০ বছর ধরে হযরত আলীকে ( আ ) মসজিদ সমূহের মিম্বরে , জুমার নামাযের খুতবায় এবং দুই ঈদের অনুষ্ঠানে সরকারী ও আনুষ্ঠানিক ভাবে গালি দেওয়া হত এবং এ ঘৃণ্য সুন্নত ও প্রথার প্রথম প্রচলনকারী ছিল মুয়াবিয়া । এরপর আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হলেও আব্বাসীয় খলীফারা হযরত আলী (আ) ও আহলুল বাইতের ( আ ) বিদ্বেষী ও বৈরী হওয়ার জন্য তখনও ঈদ - ই গাদীর উদযাপনের প্রশ্নই আসে না । অবশেষে হিজরী ৪র্থ শতাব্দীতে আব্বাসীয় খিলাফত ও রাজধানী বাগদাদের ওপর আহলুল বাইতের ( আ ) সমর্থক আল - ই বুওয়াইহ আমীরগণ কর্তৃত্ব লাভ করলে ৩৬০ হিজরীর পর ঈদ - ই গাদীর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার পাশাপাশি আনুষ্ঠানিক ভাবে উদযাপন এবং ইমাম হুসাইনের (আ ) শাহাদাত ও আশুরার শোকানুষ্ঠান পালনের অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে আহলুল বাইতের (আ) মধ্যে উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফতের ঐ শ্বাসরুদ্ধকর শাসনামলেও ঈদ - ই গাদীর একদম ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই উদযাপিত এবং ইমাম হুসাইনের ( আ ) স্মরণে শোকানুষ্ঠান পালিত হত । অতএব বৈরী উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফত প্রশাসন কখনোই যে ঈদ - ই গাদীর উদযাপনের অনুমতি দেয় নি তা অতি সহজেই বোঝা যায় । এখন যদি কেউ বলে যে যেহেতু সাহাবা ও তাবেয়ীগণ ঈদ - ই গাদীর উদযাপন ও ইমাম হুসাইনের (আ ) শোকানুষ্ঠান পালন করেন নি বলে এ সব অনুষ্ঠান পালন বিদাত ও নিষিদ্ধ তাহলে সহজেই বোঝা যাবে যে সে আহলুল বাইত ( আ ) বিদ্বেষী ও বৈরী উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফতের অভিমত ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কথা বলছে । আর আহলুল বাইত ( আ ) থেকে মুসলিম উম্মাহকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বনী উমাইয়া খিলাফত মুসলিম উম্মাহর ক্ষতি ও ধ্বংস সাধনই করেছে । এ কারণেই মহানবী (সা) উম্মতকে সতর্ক করে বলেছেন : আমার উম্মতের ধ্বংস ( নিহিত রয়েছে ) কতিপয় কুরাইশী অল্প বয়স্ক ব্যক্তির হাতে ।
 
هلکة أمتي علی أیدي غلمة من قریش 
 
দ্র : সহীহ বুখারী , হাদীস নং ৭০৫৮ , পৃ : ১৭৭৪ - ১৭৭৫ , 
এই অল্প বয়স্ক কুরাইশীয়রা কারা ? তারা ছিল বনী উযমাইয়া বংশীয় খলীফা ও শাসকবর্গ যেমন : ইয়াযীদ ও বনী মারওয়ানের খলীফারা।
হযরত আলীর ( আ ) সাথে উম্মতের গাদ্দারী ( বিশ্বাসঘাতকতা ও খিয়ানত ) সম্পর্কে সহীহ বিশুদ্ধ হাদীসে মহানবী ( সা ) তাঁকে বলেছেন : নিশ্চয়ই এই উম্মত আমার পরে তোমার সাথে গাদ্দারী ( বিশ্বাসঘাতকতা ও খিয়ানত ) করবে ; অথচ তুমি জীবন যাপন করবে আমার ধর্মের ( মিল্লাত ) উপর এবং আমার সুন্নাহর উপর নিহত ( শহীদ ) হবে ; যে তোমাকে ভালোবাসবে সে আমাকেই ভালোবাসবে এবং তোমাকে যে ঘৃণা ( বুঘয بُغض ) করবে সে আমাকেই ঘৃণা করবে ; আর এটা অর্থাৎ তাঁর হযরত আলীর - আ - মাথা থেকে দাঁড়ি রক্ত রঞ্জিত হয়ে যাবে ( অর্থাৎ তিনি গাদ্দার উম্মতের হাতে শহীদ হবেন ) ।
( দ্র : আল - হাকিম নিশাপুরী  , আল - মুস্তাদ্রাক আলাস সাহীহাইন , খ : ৩ , পৃ : ৩৫৩ , হাদীস নং ৪৭৪৪ ; আর হাকিম এ হাদীসটি সহীহ বলেছেন এবং আল্লামা যাহাবীও আত - তালখীস গ্রন্থে তাঁর সাথে একমত পোষণ করে বলেছেন যে এ হাদীসটি সহীহ । )
 
عن حیان الأسدي سمعتُ علیاً یقول: قال لي رسول الله - ص - إنّ الأمّةَ ستغدر بک بعدي و أنت تعیش علی ملّتي و تُقتَلُ علیٰ سنّتي ، من أحبّک أحبّني ، و من أبغضک أبغضني  ، و إنّ هٰذه ستُخضبُ من ه‍ٰذا یعني لحیته من رأسه . صحیح . وافقه الذهبي في التلخیص  : صحیح .  
 
ইমাম হুসাইনের ( আ ) হত্যাকারী মহানবীর ( সা ) উম্মত :
নবী পত্নী উম্মুল মু'মিনীন হযরত উম্মে সালামাহ্ ( রা ) বলেন : আমার ঘরে রাসূলুল্লাহর ( সা ) সামনে হাসান ও হুসাইন - আলাইহিমাস সালাম - খেলছিলেন। তখন জিবরাঈল ( আ ) অবতীর্ণ হয়ে হুসাইনের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে বললেন : " হে মুহাম্মাদ! আপনার পরে আপনার উম্মত আপনার এই সন্তানকে ( দৌহিত্র) হত্যা করবে । " অত:পর রাসূলুল্লাহ ( সা ) হুসাইনকে বুকে টেনে নিয়ে কাঁদলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ ( সা ) বললেন : " আমি তোমার ( উম্মে সালমাহ্ ) কাছে এই মাটিটা রাখলাম। " অত:পর রাসূলুল্লাহ ( সা ) ঐ মাটিটার ঘ্রাণ নিয়ে বললেন : কারবালা অথবা কার্ব্ ( কষ্ট ) ও বালার ( বিপদাপদ ) ঘ্রাণ । " এবং তিনি আরও বললেন : হে উম্মে সালামাহ্ ! যখন এ মাটি রক্তে পরিণত হবে তখন জানবে যে আমার সন্তান ( দৌহিত্র হুসাইন ) নিহত হয়েছে । " 
   হযরত উম্মে সালামাহ্ ঐ মাটি একটা কাঁচের পাত্রে রেখে দিলেন এবং তিনি প্রতিদিন ঐ মাটির দিকে তাকিয়ে বলতেন : " ( হে মাটি ! ) এক মহাবিপদের দিবসে ( ইমাম হুসাইন - আ - যেদিন শাহাদাত বরণ করবেন সেদিন অর্থাৎ ৬১ হিজরীর ১০ মুহররম ) তুমি রক্তে পরিণত হবে । " 
আর এতদ সংক্রান্ত এ অনুচ্ছেদে হযরত আয়েশা ( রা ) , হযরত যাইনব বিনতে জাহশ ( রা ) , হযরত উম্মে ফযল ( রা ) , বিনতুল হারিস ( রা ) , হযরত আবু উমামাহ ( রা ) , হযরত আনাস ইবনুল হারিস ( রা ) এবং আরো অন্যদের থেকে ( অনুরূপ হাদীস বর্ণিত হয়েছে ও ) বিদ্যমান আছে । ( দ্র : ইবনে হাজার আল আস্কালানী প্রণীত তাহযীবুত তাহযীব , খ : ২ , পৃ : ৩৪৭ )  
হাদীস বর্ণনা ও চর্চায় নিষেধাজ্ঞার মারাত্মক ধ্বংসাত্মক অপূরণীয় ক্ষতি : 
  এ নিষেধাজ্ঞার সুযোগে ইসলাম ও আহলুল বাইত (আ) বিদ্বেষী ও বৈরী উমাইয়া রাজতান্ত্রিক খিলাফত প্রশাসন কর্তৃক মহানবীর সকল সুন্নত এমনকি নামায পর্যন্ত পরিবর্তিত করে দেওয়া হয়েছিল ।
کُلُّ سُنَنِ رَسُوْلِ اللّٰهِ - ص - قَدْ غُیِّرَتْ حَتَّی الصَّلَوٰةُ .
দ্র: বায়হাকী প্রণীত মারিফাতুস সুনান ওয়াল আসার , খ : ৩ , পৃ : ৪৬ ,  হাদীস নং ১৯১৩ 
এবং ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইদ্রীস আশ শাফেয়ী প্রণীত কিতাবুল উম্ম্ , খ : ২ , পৃ : ৫৭ - ৫৯ , দার ইহয়াতিত তুরাস আল - আরাবী , বৈরূত , লেবানন , ২০০১ বনী উমাইয়া হযরত আলীর ( আ ) প্রতি বিদ্বেষ পোষণের কারণে মহানবীর ( সা ) সুন্নাহ ত্যাগ করেছিল । কারণ , হযরত আলী ( আ ) মহানবীর ( সা ) সুন্নাহর একনিষ্ঠ পায়বন্দ ( অর্থাৎ তিনি সুন্নাহ যথাযথ মেনে চলতেন ) । হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস মুয়াবিয়া ও তার অনুসারীদেরকে লানৎ দিয়ে বলেছেন : হে আল্লাহ তাদেরকে  অভিশপ্ত করুন ; কারণ তারা হযরত আলীর প্রতি বিদ্বেষ বশত : সুন্নাহ তরক ( ত্যাগ ) করেছে।
اَللّٰهُمَّ الْعَنْ فَقَدْ تَرَکُوا السُّنَّةَ مِنْ بُغْضِ عَلِيٍّ .
সিন্দী পাদটীকায় বলেছেন :  তাঁর অর্থাৎ আলী বিদ্বেষের কারণে ; হযরত আলী ( আ ) সুন্নাহর পায়বন্দ ছিলেন ( সুন্নাহ মেনে চলতেন ) । তাই এরা ( মুয়াবিয়া ও তার সমর্থকরা অর্থাৎ বনী উমাইয়া) তাঁর প্রতি বিদ্বেষ পোষণের কারণে সুন্নাহ্ ত্যাগ করেছিল । 
قال السندي - في التعلیق علیه - أي لأجل بغضه ای هو - علي - کان یتقید بالسنن فهؤلاء ترکوها بعضاً له . 
দ্র : সুনান - ই নাসাঈ, খ : ৫ , পৃ : ২৫৩ , আস - সুনান আল - কুবরা , খ : ৭ , পৃ : ২৪৪ 
এ থেকে বোঝা যায় যে মহানবীর ( সা ) হাদীস ও সুন্নাহর ওপর কী ভয়াবহ আঘাত এসেছে এবং সকল সুন্নাহ এমনকি দ্বীনের স্তম্ভ নামাযেও বিকৃতি সাধন ও পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে জাল হাদিস তৈরি করে। আর এ সব বিপর্যয় ঘটেছে মহানবীর ওফাতের পর পরই হাদীস বর্ণনা ও চর্চায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার ফলে এবং বনী উমাইয়া ও বনী আব্বাসের রাজতান্ত্রিক খিলাফত ও প্রশাসনের তত্ত্বাবধান ও কঠোর নিয়ন্ত্রণে হাদীস সংকলনের জন্য। অতএব এত সব জঘন্য বিষয় যখন ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীতে ঘটেছিল এমনকি উম্মতের ধ্বংসও সাধিত হয়েছিল তখন এই প্রথম তিন শতাব্দী খাইরুল কুরূন ( خیر القرون ) অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ শতাব্দী হয় কিভাবে ? আহলুল বাইত ( আ) বৈরী ও বিদ্বেষী এ সব রাজতান্ত্রিক খিলাফত প্রশাসনের কঠোর নিয়ন্ত্রণে আহলুল বাইতের ( আ ) ফাযায়েল এবং ওয়িলায়ত , ইমামত ও খিলাফত সংক্রান্ত হাদীস একদম প্রচার করতে দেওয়া হয় নি অথবা কিছু হাদীস প্রচারিত হলেও সেগুলোর অর্থ বিকৃত বা অপব্যাখ্যা করা হত যেমন: গাদীর -ই খুমের হাদীসের অর্থ বিকৃত করে মাওলা শব্দের অর্থ অভিভাবক ও কর্তৃত্বশীল কর্তৃপক্ষ না করে বন্ধু করা হয়েছে : আমি যার বন্ধু এই আলী তার বন্ধু !!! 
মুতাওয়াতির হাদীস - ই সাকালাইন : [[ আমি তোমাদের কাছে দুটো অতি ভারী ও মূল্যবান জিনিস, যে পর্যন্ত এ দুভয়কে আঁকড়ে ধরে রাখবে সে পর্যন্ত তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট ও গোমরাহ হবে না : মহান আল্লাহর কিতাব ও আমার অতি নিকটাত্মীয় ও রক্তজ বংশধর ( ইতরাৎ ) যারা আমার আহলুল বাইত (আ) । আর আমার কাছে হাউযে কাওসারে উপনীত হওয়া পর্যন্ত এদুভয় কখনো পরস্পর পৃথক হবে না। ]] প্রচার না করে দুর্বল ভিত্তিহীন হাদীস : আমি তোমাদের কাছে রেখে যাচ্ছি দুটো অতি ভারী ও মূল্যবান জিনিস: আল্লাহর কিতাব কুরআন ও আমার সুন্নাহ্ ..... বহুল প্রচার করেছে যে এরফলে জনগণ সাকালাইন ( অতি মূল্যবান ভারী জিনিস দ্বয় ) বলতে " পবিত্র কুরআন ও আহলুল বাইত ( আ ) " নয় পবিত্র " কুরআন ও সুন্নাহ " বুঝে থাকে !! " নিশ্চয় হাসান ও হুসাইন বেহেশতের যুবকদের নেতা । " --- মুতাওয়াতির এ হাদীস এবং তাদের ফাযায়েলের অন্যান্য হাদীস প্রচার ও চর্চা না হওয়ায় উম্মতের চোখের সামনে ইয়াযীদ ও বনী উমাইয়া ৬১ হিজরীর ১০ মুহররম ইমাম হুসাইনকে ( আ‌ ) তাঁর সঙ্গী সাথী সন্তান ও নিকটাত্মীয় সহ কারবালায় নৃশংস ভাবে হত্যা করে । এ সব অপকর্ম সম্ভব হয়েছে প্রথম তিন খলীফার শাসনামলে ও বনী উমাইয়ার খিলাফত কালের  এক দীর্ঘ সময় রাসূলুল্লাহর ( সা ) হাদীস বর্ণনা , সংকলন ও চর্চা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে ।  
যে উম্মত মহানবীর (সা) ওফাতের পরে হযরত আলীর সাথে গাদ্দারী (বিশ্বাসঘাতকতা) করেছে ( এবং এ কারণে তিনি শহীদ হয়েছেন ) এবং মহানবীর দৌহিত্র জান্নাতের যুবকদের নেতা ইমাম হুসাইনকে ( আ‌ ) শহীদ করেছে কারবালায় এবং মহানবীর পরে তাঁর হাদীস বর্ণনা ও চর্চায় নিষেধাজ্ঞা এবং মহানবীর সুন্নাহর বিকৃতি ও পরিবর্তন সাধন এমনকি নামাযের বিকৃতি পর্যন্ত মেনে নিয়েছে তারা কি কখনো ঈদ - ই গাদীর উদযাপন করবে ? ঈদ - ই গাদীরের কথা এবং সে দিন মহানবী যা বলেছিলেন তা কি তারা স্মরণ করবে ? এটা কি আশা করা যায় ?  আর এ থেকে বোঝা  যায় যে হাদীস বর্ণনা ও চর্চায় কঠোর নিষেধাজ্ঞা এবং আহলুল বাইতের কট্টর বিদ্বেষী ও বৈরী বনী উমাইয়া রাজতান্ত্রিক শাসন বজায় থাকার জন্য  সাহাবা ও তাবেয়ীদের যুগে  কেন ঈদ - ই গাদীর উদযাপিত হয় নি ? !!  মহানবীর আহলুল বাইত ( আ ) যাদের অটুট বন্ধন কিয়ামত পর্যন্ত পবিত্র কুরআনের সাথে বিদ্যমান তারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে ইসলাম , পবিত্র কুরআন এবং মহানবীর ( সা ) পবিত্র সুন্নাহ সঠিক ভাবে সংরক্ষণ করেছেন বলেই তাঁদের সীরাত ও সুন্নাহয় ঈদ - ই গাদীর উদযাপনের নিদর্শন ও আহবান জোরালো ভাবে বিদ্যমান । আর আমরা সবাই পবিত্র কুরআন এবং মহানবীর আহলুল বাইতের (আ ) আদর্শ দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে ধরার জন্য আদিষ্ট হয়েছি মুতাওয়াতির হাদীস - ই সাকালাইনে । 
ইসলামী চিন্তাবিদ এবং গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান
 
captcha