IQNA

ইমাম হুসাইনের (আ) চিরঞ্জীব মহাবিপ্লব-১

শিমার ও ওমর সাদরাও জেনারেল হোরের মত ইমাম-শিবিরে যোগ দিলে কারবালার ইতিহাস হত ভিন্ন

4:18 - July 30, 2022
সংবাদ: 3472200
তেহরান (ইকনা): শোকাবহ মহররম উপলক্ষে ইমাম হুসাইনের (আ) চিরঞ্জীব মহাবিপ্লব শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার প্রথম পর্ব থেকে সবাইকে জানাচ্ছি সংগ্রামী সালাম ও গভীর শোক আর সমবেদনা।
শহীদ-সম্রাট বা শহীদদের নেতা হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) বলেছেন,'যদি মুহাম্মাদ (সা)-এর ধর্ম আমার নিহত হওয়া ছাড়া টিকে না থাকে তাহলে, এসো হে তরবারি! নাও আমাকে।'
 
নিঃসন্দেহে কারবালার মর্ম বিদারী ঘটনা মানব ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় ঘটে যাওয়া অজস্র ঘটনাবলীর মধ্যে  শিক্ষা ও গুরুত্বের দিক থেকে অনন্য। এটা এমন এক মহা-বিস্ময়কর ঘটনা, যার সামনে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষ বিশ্বের মহান চিন্তাবিদরা থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন,পরম বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তারা স্তুতি-বন্দনায় মুখরিত হয়েছেন এই নজিরবিহীন আত্মত্যাগের। কারণ, কারবালার কালজয়ী বিপ্লবের মহানায়করা‘‘অপমান আমাদের সয় না” -এই স্লোগান ধ্বনিত করে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংখ্যায় হাতে গোনা হওয়া সত্ত্বেও খোদায়ী প্রেম ও শৌর্যে পূর্ণ টগবগে অন্তর নিয়ে জিহাদ ও শাহাদাতের ময়দানে আবির্ভূত হন এবং প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার অধঃজগতকে পেছনে ফেলে উর্ধ্বজগতে মহান আল্লাহর সনে পাড়ি জমান। তারা নিজ কথা ও কাজের মাধ্যমে জগতবাসীকে জানিয়ে দিয়ে যান যে,‘‘ যে মৃত্যু সত্যের পথে হয়, তা মধুর চেয়েও সুধাময়।’’
 
                          জীবনের চেয়ে দৃপ্ত মৃত্যু তখনি জানি
 
                        শহীদী রক্তে হেসে ওঠে যবে জিন্দেগানি।
 
বিশ্বের অধিকাংশ মুসলমানের জীবনপটে যেমন, তেমনি তাদের পবিত্র বিশ্বাসের পাদমূলেও আশুরার সঞ্জীবনী ধারা বহমান। কারবালার আন্দোলন সুদীর্ঘ চৌদ্দশ’ বছর ধরে-সুগভীর বারিধারা দিয়ে জুড়িয়ে দিচ্ছে সত্য ও মানবতা-প্রেমী প্রাণগুলোকে। আজও মূল্যবোধ, আবেগ, অনুভূতি, বিচক্ষণতা ও অভিপ্রায়ের অযুত-অজস্র সূক্ষ্ম ও স্থূল বলয় বিদ্যমান যা এই আশুরার অক্ষকে ঘিরে আবর্তনশীল। প্রেমের বৃত্ত অঙ্কনের কাঁটা-কম্পাস স্বরূপ হলো ইমাম হুসাইনের চির-উন্নত ও চিরঞ্জীব এ মহাবিপ্লব। 
 
নিঃসন্দেহে এই কালজয়ী বিপ্লবের অন্তঃস্থ মর্মকথা এবং এর চেতনা, লক্ষ্য ও শিক্ষা একটি সমৃদ্ধশালী, নিখাঁদ ও প্রেরণাদায়ক সংস্কৃতি গঠন করে। প্রকৃত ইসলামের সুবিস্তৃত অঙ্গনে এবং আহলে বাইতের সুহৃদ ভক্তকুল, ছোট-বড়,জ্ঞানী-মূর্খ নির্বিশেষে সর্বদা এই আশুরা সংস্কৃতির সাথেই জীবন যাপন করেছে, বিকশিত হয়েছে এবং এ জন্যে আত্মাহুতি দিয়েছে।
 
বীরত্বপূর্ণ কথা হল সেই কথা যা দিয়ে মানুষের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বিপুল অনুপ্রেরণা ও অদম্য শক্তি যোগানো যায়। আর প্রকৃত বীরপুরুষ হলেন সেই ব্যক্তি  যার মধ্যে অন্যায় রোধের এ মানসিকতা জোয়ারের মতো উথলে পড়ে। যার মধ্যে মহত্ত্ব, ন্যায়পরায়ণতা, দৃঢ়তা,সততা,সত্যতা,অধিকার রক্ষায় কঠোরতা, সৎ-সাহস এবং মুক্তবুদ্ধি রয়েছে তিনিই হলেন আসল বীরপুরুষ।
 
কারবালা ঘটনার একপিঠে রয়েছে পাশবিক নৃশংসতা ও নরপিশাচের কাহিনী এবং এ কাহিনীর খলনায়ক বা চরম কাপুরুষেরা ছিল ইয়াযিদ,ইবনে সা’দ,ইবনে যিয়াদ এবং শিমাররা। আর অপর পিঠে ছিল একত্ববাদ, দৃঢ় ঈমান, মানবতা, সাহসিকতা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা এবং সত্য প্রতিষ্ঠায় আত্মদানের কাহিনী এবং এ কাহিনীর বিশ্ববিশ্রুত ব্যক্তিত্বরা হলেন শহীদ সম্রাট ইমাম হুসাইন (আ.),তাঁর বোন হযরত যাইনাব এবং তাঁর ভাই হযরত আব্বাসরা, যাদেরকে নিয়ে বিশ্বমানবতা গৌরব করতে পারে। তাই কারবালা ঘটনার সমস্তটাই ট্রাজেডি বা বিষাদময় নয়। অবশ্য পৃথিবীতে বহু ঘটনাই ঘটেছে যেগুলোর কেবল একপিঠ রয়েছে অর্থাৎ এসব ঘটনা কেবলমাত্র দুঃখজনক ও শোকাবহ। কিন্তু কারবালার উজ্জ্বল অধ্যায় কালো অধ্যায়ের চেয়ে লক্ষ কোটি গুণে ব্যাপক ও শ্রেষ্ঠ। তাই শহীদ সম্রাট ইমাম হুসাইন (আ.) আশুরার রাতে তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরকে প্রশংসা করে বলেনঃ ‘‘আমি পৃথিবীতে তোমাদের চেয়ে বিশ্বস্ত ও উত্তম কোনো সহযোগীর সন্ধান পাইনি।’’ (দ্রঃ তারিখে তাবারীঃ ৬/২৩৮-৯,তারিখে কামেলঃ ৪/২৪,(
 
ইমাম হুসাইনের এ মহাবিপ্লব কেন বিশ্ব-নন্দিত ও চিরঞ্জীব এবং কেনইবা ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃখজনক ও সন্ত্রাসী হত্যাযজ্ঞ মহানবীর হিজরতের ৬৩ বা ৬৪ বছরের মধ্যেই সংঘটিত হল তার বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও প্রেক্ষাপট জানা খুবই জরুরি।
 
খোদাপ্রেম, একনিষ্ঠতা ও আত্মত্যাগের যে গভীরতা কারবালার বীর শহীদদের মধ্যে দেখা গেছে তা নজিরবিহীন ছিল বলেই ইমাম হুসাইনের এ মহাবিপ্লব হয়েছে নজিরবিহীন, বিশ্ব-নন্দিত ও চিরঞ্জীব। ইমাম ও তাঁর প্রায় ৭২ জন সঙ্গী প্রায় ত্রিশ হাজার বা তারও বেশি সশস্ত্র প্রাণঘাতী যোদ্ধার বিরুদ্ধে জিহাদ করতে গিয়ে এক মুহূর্তের জন্যও ভীত, দ্বিধান্বিত ও সত্যের পথে অবিচলতার ক্ষেত্রে দুর্বল ভাবনার শিকার হননি। ইমামের সঙ্গীদের মধ্যে এমন ব্যক্তিরাও ছিলেন যারা আগামীকাল শহীদ হবেন বলে জেনেও পরস্পরের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টাও করছিলেন! সত্যের পথে কারা আগে শহীদ হবেন সে নিয়ে নবী-পরিবারের সদস্য ও নবী-পরিবারের বাইরের সদস্যদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও ছিল লক্ষণীয়! উভয় গ্রুপই বলছিল আমরা পরে শহীদ হয়ে রাসুলকে কিভাবে মুখ দেখাব যখন রাসুল বলবেন, আমার উম্মতের সদস্যদের আগে শহীদ হতে দিলে অথবা তোমরা আমার কেমন উম্মত যে আমার পরিবারের লোকদের আগে শহীদ হতে দিলে? !!
 
ইমাম হুসাইন-আ. তাঁর সঙ্গীদেরকে আত্মরক্ষার্থে চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়া সত্ত্বেও তাঁরা ইমামকে ত্যাগ করে কাপুরুষের মত নিজ জীবন বাঁচানোর কথা কল্পনাও করতে পারেনি! তাঁদের কেউ কেউ ইমামের জন্য হাজার বার নিহত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করছিলেন! ইমামের ১৩ বছর বয়স্ক ভাতিজা হযরত কাসেম পর্যন্ত বললেন, সত্যের পথে শহীদ হওয়াটা তাঁর কাছে মধুর চেয়েও বেশি মিষ্টি!  এ অবস্থায় ইমাম তাঁর সঙ্গীদের সবাইকে শাহাদাতের আগের দিন রাতেই বেহেশতে তাঁদের অবস্থান কোথায় হবে তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন! অন্যদিকে খোদাদ্রোহী ইয়াজিদ শিবিরের প্রায় সবাই কিভাবে অতটা পাষণ্ড, কাপুরুষ ও ঈমানহীন হতে পেরেছিল? যদিও ব্যতিক্রমও ছিল, যেমন জেনারেল হোর! হোর যুদ্ধ অনিবার্য দেখে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অসত্যের শিবির থেকে ন্যায় ও সত্যের শিবির তথা ইমামের শিবিরে যোগ দিয়ে সবার আগে শহীদ হন। জেনারেল শিমার ও ওমর সাদরাও যদি একই কাজ করত তাহলে কারবালার ইতিহাস বদলে যেত ও ইমাম হুসাইনের ইসলামী সংস্কার-আন্দোলনের ফলে  ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মত মহাসাফল্য অর্জনও সে সময়ই অনিবার্য হয়ে পড়ত। এসব বিষয় ও কারবালার মহাবিপ্লবের প্রেক্ষাপট নিয়ে আমরা কথা বলব আগামী পর্বগুলোতে। পার্সটুডে
captcha